রাকিবুল ইসলাম

কোটিপতি- একটি স্বাপ্নিক শব্দ। সবারই আশা ও স্বপ্ন থাকে সে একদিন কোটিপতি হবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় কোটিপতি তো দূরের কথা আমরা লাখপতি ও হতে পারি না। তার উপর আমাদের বেশির ভাগ মানুষ অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় জীবন পার করে দেয়। ভাগ্যের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে আমরা বাঁচার জন্য বেঁচে থাকি।

অনেকে মনে করেন কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন স্রেফ দিবাস্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু না, কোটিপতি হওয়াটা অবাস্তব কিছু না। তবে আপনাকে ৪টি গোপন সূত্র জানতে হবে। আমাদের স্কুল-কলেজে এগুলো শেখানো হয় না। সেখানে আমাদের শুধু আয়-উপার্জন করার জন্য যা প্রয়োজন, সেগুলো শেখানো হয়।

আয় বা উপার্জন হল কোটিপতি হওয়ার প্রথম ধাপ। আরো ৩ টি ধাপ রয়েছে সাফল্যের সিঁড়িতে। কি কি সেগুলো? কি সেই গোপন সূত্র? চলুন জেনে নিই-

১. আয় বা উপার্জন


আপনার আয় আপনার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বা কোটিপতি হওয়ার জন্য খুব ই গুরুত্বপূর্ণ। কখনোই একটি মাত্র ইনকামের উপরে নির্ভর করা যাবে না। প্রতি কোটিপতির গড়ে ৭ টি ইনকাম সোর্স রয়েছে। আর নতুন কোটিপতিদের আছে ৩ টি করে আয়ের উৎস।

আপনি চাকরি কিংবা ব্যবসা যাই করেন না কেন, এটিকে আপনার প্রাথমিক আয়ের উৎস হিসেবে ধরতে হবে। প্রথমে আপনাকে এরকম একটি প্রাথমিক আয়ের সোর্স নিশ্চিত করতে হবে।

এরপর আপনাকে চেস্টা করতে হবে কিভাবে আরেকটি আয়ের উৎস তৈরি করা যায়। এটি হতে পারে পার্ট টাইম আরেকটি চাকরি করা। অথবা ছোট কোন পার্ট টাইম ব্যবসা করা। আবার আপনি কোন চাহিদা সম্পন্ন পণ্য কিনে কিছুদিনের জন্য মজুত করে মুনাফা সহ বিক্রি করতে পারেন। কোন উপায় না পেলে কমপক্ষে টিউশনি করাতে পারেন।

ধীরে ধীরে আপনার আয়ের উৎস বাড়িয়ে ৩-৪ টি সোর্সে নিয়ে যাওয়ার চেস্টা করুন।

মনে রাখবেন, আপনি কত কম সময়ের মধ্যে কোটিপতি হতে পারবেন কিংবা আদৌ হতে পারবেন কি না, তা নির্ভর করবে আপনি কতটা আয় করছেন। যেভাবেই হোক আপনার আয়ের উৎস বাড়াতে কাজ করুন। ভেবে দেখুন কি এমন কাজ আছে যা আপনি করতে পারে। অথবা কি এমন ব্যবসা আছে যা আপনার মাসিক আয় বাড়াবে। তবে সবকিছুর উপরে যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে তা হল- আপনার আয় যেন অবশ্যই সৎ ও ন্যায়ের পথে হয়। অন্যথায় আপনার কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে গুড়েবালি। অসৎ টাকা দিয়ে আপনি কোটিপতি হতে পারবেন না। আর যদি কেউ সেরকম হয়ও, সেটা ক্ষণস্থায়ী।

২. সঞ্চয়-

সঞ্চয় ই ধনী-গরীবের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়। এখন আপনি হয়ত বলবেন- আমি খুব ই কম টাকা আয় করি, আমার দ্বারা সঞ্চয় সম্ভব নয়। কিংবা- আমার পরিবারের খরচ আমার আয়ের থেকে বেশি, প্রতি মাসে আমাকে ধার করতে চলতে হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি।

তবে বিশ্বাস করুন, শুধুমাত্র আপনি নয়, ৯০ শতাংশ মানুষ আপনার মত সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের অযুহাত দেয়। আর এজন্যই ৯০ শতাংশের কাছে যত টাকা থাকে বাকি ১০ শতাংশের নিকট তাঁদের থেকে বেশি টাকা থাকে।

সঞ্চয় এর জন্য আপনি কতটাকা আয় করছেন, সেটা মুখ্য বিষয় নয়। সঞ্চয়ের মানসিকতাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর এটি একদিনে তৈরি হবে না। ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। মনে রাখবেন, টাকার পরিমান নয়, টাকা সম্বন্ধে মানসিকতাই আপনাকে কোটিপতি বানাবে।

এখন কথা হল, প্রতি মাসে আপনাকে কত টাকা সঞ্চয় করতে হবে? এখানে কোন নির্দিস্ট পরিমান নেই। আপনাকে শতাংশের উপরে নির্ভর করতে হবে। সাধারনত আপনার আয়ের ১০% সঞ্চয় করা আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। তবে আপনি একবারেই হঠাত করে ১০% সঞ্চয় করতে পারবেন না। আবার পারলেও কস্ট হয়ে যাবে আপনার জন্য। দেখা যাবে এক মাস সঞ্চয় করে পরবর্তী মাসে সেটা চালিয়ে যেতে পারছেন না।

এজন্য আমি বলব, আপনি ১% থেকে শুরু করুন। খুব কম হয়ে যায়? তাতেও সমস্যা নেই। এই সামান্য অংশ থেকেই আপনার সঞ্চয়ের অভ্যাস তৈরি হবে। প্রতি মাসে আপনার সঞ্চয় ১% বাড়ান। আর ১% ব্যয় কমান। খুঁজে বের করুন কোথায় আপনি ১% ব্যয় কমাতে পারেন। ভাবুন। চেস্টা করুন।

এভাবে দশম মাসে গিয়ে আপনি ১০% সঞ্চয় করতে পারবেন। হয়ত কারো কারো ২-১ মাস হময় বেশি কম লাগতে পারে। তবে ১০% হওয়ার পড়ে আর বাড়াবেন না। আরো ৬ মাস ১০% হিসেবে সঞ্চয় করুন। এরপর আবার আপনার আয়ের অবস্থা বুঝে সঞ্চয় এর শতাংশ বাড়াবেন।

** সঞ্চয় কখনো কমানো যাবে না, ব্যয় কখনো বাড়ানো যাবে না।

কিভাবে সঞ্চয় করবেন-

  1. আপনার বাসা বা অফিস থেকে দূরে আকটি ব্যাংক নির্বাচন করুন, যেখানে নিয়মিত যেতে আপনার কস্ট হবে।
  2. ওই ব্যাংকে একটি সেভিংস একাউন্ট খুলুন। ভুলেও চেকবই অথবা ডেবিট কার্ড নিবেন না।
  3. কোন কোন ব্যাংকে চেক বই বাধ্যতামূলক নিতে হয়। সেক্ষেত্রে চেক বইটি আপনার নাগালের বাইরে রাখুন। কোন বিশ্বস্ত বন্ধু বা আত্মীয়ের কাছে রাখতে পারেন। কোনভাবেই বাসা বা অফিসে রাখা যাবে না।
  4. পরিবারের কাউকে জানানো যাবে না।
  5. মাসিক বেতন পাওয়ার সাথে সাথে আপনি ওই একাউন্টে প্রথমে টাকা জমা রাখবেন। এরপর আপনার প্রাত্যহিক ব্যয় করবেন              

** আপনি স্বল্পমেয়াদী ডিপিএস ও করতে পারেন। তবে সমস্যা হল, ডিপিএস এ টাকা জমা করলে আপনার মাঝে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে উঠবে না। এক প্রকার বাধ্য হয়ে আপনাকে ডিপিএস এ টাকা জমা দিতে হবে।

অতএব সাধারণ একাউন্টে সঞ্চয়ের অভ্যাস তৈরি করাই সর্বোত্তম উপায়।

৩. বিনিয়োগঃ

সঞ্চয় তো করলেন, এখন কি করবেন? আমাদের সকলের ই একটাই লক্ষ্য থাকে আমরা ১৫-২০ বছর ধরে টাকা ডিপিএস এ জমা করব। এরপর সেই টাকার সাথে ব্যাংক ঋণ নিয়ে একটা বাড়ি বানাবো। এরপর ৩৬ বছর ধরে ওই ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করব। মোট ৫৬ বছর পরে আমি কোটিপতি হয়ে যাব।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই সমীকরণ এখন আর কাজ করে না। আপনি নিশ্চয়ই অর্ধশত বছর পরে একটি বাড়ির মালিক হয়ে নিজেকে কোটিপতি দাবী করতে ইচ্ছুক নন। তাহলে কিভাবে সম্ভব?

সঞ্চয় শুধু সঞ্চয়ের জন্য করলে হবে না। কোটিপতি হওয়ার জন্য আপনার সঞ্চয়কৃত টাকা আপনাকে বিনিয়োগ করতে হবে। অবশ্যই বুঝে শুনে। কমপক্ষে ১লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয় করুন। এর আগে বিনিয়োগের কথা চিন্তা করবেন না।

১ লক্ষ টাকার অর্ধেক, অর্থাৎ সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা এককালীন বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগের জন্য নির্ধারণ করুন। ৫০০০-১০০০ টাকা- এরকম ছোট ছোট বিনিয়োগের ক্ষেত্র খুঁজতে থাকুন। আপনার বন্ধুর কোন ব্যবসায় আপনি বিনিয়োগ করতে পারেন। আবার আপনি কোন পণ্য স্বল্প সময়ের জন্য মজুত করে বিক্রি করতে পারেন। এভাবে চারদিকে বিনিয়োগের ক্ষেত্র খুঁজতে থাকুন। চেস্টা করুন যাতে ১০% মুনাফা হয়- এরকম ক্ষেত্রে খুঁজে বের করতে পারেন।

১ লক্ষ বা ৫০ হাজার শুধুমাত্র উদাহরণ স্বরূপ। আপনি প্রথমে একটা ভাল অংকের টাকা জমিয়ে সেখান থেকে অর্ধেক টাকা বিনিয়োগ করুন। ভুলেও আপনার সঞ্চয়ের পুরোটা বিনিয়োগ করবেন না। কখনোই না।

আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা বিনিয়োগে ভয় পান। এটা ঠিক আপনি যদি বুঝে শুনে বিনিয়োগ না করতে পারেন, তবে আপনার অর্থ খোয়া যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ঝুঁকি এড়াতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিচের সাধারণ জ্ঞানগুলো মেনে চলবেন-

  1. পূর্বে কখনো ব্যবসা করেননি- এমন ব্যক্তির সাথে বিনিয়োগ করবেন না।
  2. কোন ব্যক্তির সাথে যৌথ বিনিয়োগ করলে তার লেনদেন সম্পর্কে অবগত হয়ে নিন।
  3. ওই ব্যক্তি দেনাগ্রস্ত কিনা তার খোজখবর নিন।
  4. কোন নির্দিস্ট ব্যবসায় অভিজ্ঞ- এমন কারো সাথে যৌথ বিনিয়োগে যাওয়া যেতে পারে।
  5. জমিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই জমির কাগজপত্র যাচাই করে নিন।
  6. পুজিবাজারে ছোট ছোট বিনিয়োগ করতে পারেন। তবে পুজিবাজারে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ করে বিনিয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বই বা ওয়েবসাইট দেখতে পারেন। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদী (৪-৫ বছর) বিনিয়োগের পরিকল্পনা থাকতে হবে।
  7. বর্তমানে অনলাইনে বিভিন্ন ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি কম বিনিয়োগে করা যায় এবং অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকি সাপেক্ষ।
  8. যৌথ বিনিয়োগের ব্যবসায় স্বচ্ছতার বিষয়টি লক্ষ্য রাখবেন। ওই ব্যবসায় অবশ্যই আপনার সম্পৃক্ততা থাকতে হবে।
  9. অতিরিক্ত মুনাফার লোভনীয় অফারে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকবেন।
  10. প্রথমে ছোট বিনিয়োগ দিয়ে শুরু করে পর্যায়ক্রমে অবস্থাবুঝে বিনিয়োগ বাড়াতে পারেন।

এভাবে আপনার সঞ্চয়কৃত টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে বাড়াতে হবে। ধীরে ধীরে অপেক্ষাকৃত বড় বিনিয়োগের দিকে আপনি যেতে পারবেন। মনে রাখবেন, আপনার নিকট যত টাকা থাকবে, আপনার নিকট তার সমমূল্যের সুযোগ এসে ধরা দিবে।

৪. সহজ জীবনযাপন

মানুষের আয় যত বাড়ে তাঁর খরচ ও তত বাড়তে থাকে। এর কোন সীমা নেই। এজন্য এই ৪র্থ স্টেপ সবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খরচ করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এটি আপনার কোটিপতি হওয়ার প্রধান অন্তরায়।

গত তিন স্টেপে আপনি জেনেছেন, কিভাবে আপনি আপনার টাকার পরিমান বৃদ্ধি করবেন। এবার আপনাকে আপনার খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আপনি যতদিনে না কোটিপতি হন, অর্থাৎ আপনার ব্যাংকে ১ কোটি টাকা জমা হয়, ততদিন আপনাকে আপনার সাধারণ জীবন যাপন চালিয়ে যেতে হবে।

প্রাথমিক আয় এর উপর ভিত্তি করে আপনার জীবন নির্বাহ করতে হবে। আপনার প্রাথমিক আয় যদি ২০০০০ টাকা হয়, আর আপনি সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাধ্যমে যদি ১ লাখ টাকার মালিক হন, তারপরও আপনার সকল ব্যয় ওই ২০০০০ টাকার মধ্যে আবদ্ধ রাখতে হবে। কোন অবস্থায়ই জীবন যাপনের খরচ বাড়ানো যাবে না। চাকরিতে প্রমোশনের কারনে বেতন বৃদ্ধি পেলেও পূর্বের ন্যায় জীবন যাপন করুন। বাড়তি টাকা সঞ্চয় করুন। 

আমি আগেই বলেছি, এই স্টেপটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং একটু কঠিন ও বটে। আপনি যদি এই সময়ে এসে ব্যর্থ হয়ে যান, তবে পেছনের কোন কিছুই আপনার কাজে আসবে না। আপনার ও আপনার পারিবারিক জীবন সাধারণ রাখতে আপনার পরিবারের সদস্যের সাথে কথা বলুন। তাঁদের বোঝান। আপনার লক্ষ্য সম্পর্কে তাঁদের অবগত করুন।

আপনি যদি উক্ত ৪ টি স্টেপ সর্বাত্মকভাবে অনুসরণ করতে পারেন, তবে আপনার কোটিপতি হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। আর হ্যাঁ, আপনি রাতারাতি কখনোই কোটিপতি হতে পারবেন না। তবে এই স্টেপগুলোর সাহায্যে আপনি অন্য যে কারো থেকে অতি দ্রুত আপনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন। কোটিপতি হওয়ার জন্য আপনার সুবিধামত একটা সময় (সাধারনত ৫ কিংবা ৭ বছর) নির্ধারন করুন। কাজে লেগে পড়ুন। সাফল্য আসবেই।