রাকিবুল ইসলাম

আমরা সবাই টাকার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করি। কিন্ত আমরা নিজেরা নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে খুশি নই। সমাজের অল্প সংখ্যক মানুষের কাছে সবার থেকে বেশি টাকা থাকে আর আমরা মাসের ২০ তারিখের পরে টাকার অভাবে হাপিত্যেশ করি। এর কারণ কি কখনো ভেবে দেখেছেন?

এক গবেষণায় দেখা গেছে পৃথিবীর প্রায় সকল ধনীরাই এ সকল অভ্যাস গুলো বজায় রেখে চলেন। অবশ্য কোন কোন ধনকুবের অকপটে স্বীকার করেছেন যে প্রথম প্রথম যখন তারা এ  বিষয়গুলো জেনেছেন, তখন বিশেষ একটা পাত্তা দেন নি। পরে দেখেছেন বাস্তবতার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। এরপর থেকে তাঁরা দৈনন্দিন জীবনে এ অভ্যাসগুলো কঠোর ভাবে মেনে চলা শুরু করেন।

যারা বংশানুক্রমে ধনী তাঁদের মধ্যে প্রায় সবাই বলেছেন যে এ বিষয়গুলো তাঁর বাবা বা পিতৃ-পুরুষেরা তাঁদের কে বলে গিয়েছেন। 

চলুন জেনে নেয়া যাক সে ধরনের ০৫ টি অভ্যাসের কথা-

১. টাকাকে সব সময় মূল্যায়ন করবেন

আমাদের অনেকের ই অভ্যাস হল হাতে টাকা আসলেই খরচ করে ফেলা। একে অবশ্য অভ্যাস না বলে ধনীরা বদভ্যাস হিসেবে অভিহিত করেছেন। যখন আমাদের হাতে টাকা আসে, তখনই বিভিন্ন জিনিস কেনার চিন্তা মাথায় আসে। তখন বন্ধুরা ট্রিট এর জন্য বায়না ধরলেও আমরা না করি না। কিন্তু ২-১ দিন পরেই আমরা আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসি। অর্থাৎ আবার খালি হাতে দিন পার করতে হয়।এই ক্ষেত্রে আপনি যদি টাকা খরচ আটকাতে চান, তবে এই অভ্যাসের চর্চা করতে পারেন।

আমরা টাকা দিয়ে বিভিন্ন মূল্যবান জিনিস পত্র কিনি। যেমন ধরুন, আপনি টাকা দিয়ে কিছু স্বর্ণালঙ্কার কিনলেন। আপনি কি সেগুলো কাউকে সহজে দিয়ে দিবেন? আবার ধরুন আপনি একটি দামি জুতা কিনেছেন। আপনার কোন বন্ধু বা আত্মীয় যদি সেটা চায়, তাহলে কি আপনি অতি সহজে চাওয়া মাত্র দিয়ে দিবেন? নিশ্চয়ই না!

পৃথিবীর সব থেকে মূল্যবান জিনিস কি- এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা সবাই বলব হীরা, সোনা বা অন্যান্য দামী পণ্য সমূহ। তবে আপনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন যে, শুধুমাত্র টাকার বিনিময় ই আপনি এ দামী জিনিসগুলো কিনতে পারেন। কিন্তু যে কোন দামী জিনিস এর বিনিময়ে আপনি সম পরিমান টাকা কখনোই পাবেন না।

মূল্যস্ফীতির কারণে আমাদের দেশে প্রতি বছর ৮% টাকার মান কমে যায়। অপরদিকে আপনি যে কোন জিনিস কিনলে কিছুদিন পরেই তাঁর ফেরত/বিক্রয় মূল্য অর্ধেক হয়ে যায় বা ৫০% কমে যায়।

আপনি যদি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেন, তাহলে টাকা ই হচ্ছে যে কোন পণ্য থেকে মূল্যবান। আপনাকে এটি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে। এটাকে আপনি সম্পূর্ণ রুপে বিশ্বাস করলে টাকা খরচের প্রবণতা কমে যাবে। আপনি আরো বেশি টাকা জমাতে পারবেন। আর এ জমাকৃত টাকাই একদিন আপনার দুর্দিনে সাহায্য করবে।যে কোন দামী জিনিস যেমন আপনি অতি সহজে কাউকে দিয়ে দিবেন না, তেমনি আপনার নিকট থাকা টাকা যাতে সহজে খরচ না করে ফেলেন, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

২. টাকার সঠিক অংক কখনোই প্রকাশ করবেন না

বেশির ভাগ মানুষ ই টাকার অংক প্রকাশ করে নিজেকে বড় হিসেবে প্রতীয়মান করতে চান। আত্মীয়-সজন বা বন্ধুদের আড্ডায় নিজের আয় এর অংকটা একটু বেশি শোনালে তাঁর সম্মান বাড়ে। আবার অনেকে তো তাঁর আয় এর দিগুন-তিনগুণ ও বলে দেন। একটা জিনিস কি ভেবে দেখেছেন, এভাবে সকলকে টাকার অংক সঠিকভাবে বা বাড়িয়ে জানালে কি কি সমস্যা হতে পারে?

এক- আপনার বন্ধু বা আত্মীয় সজনের মধ্যে আপনার থেকে কেউ কম টাকা আয় করলে তাঁর মধ্যে একটু অসস্তি ভাব লক্ষ্য করা যাবে। তিনি হীনমণ্যতায় ভুগবেন।তিনি নিজেকে ছোট ভাববেন। আপনি কি আপনার বন্ধুর বা আত্মীয়র হীনমণ্যতার কারণ হতে চান?

দুই- আপনি যখন দেখবেন যে আপনার বন্ধুদের মধ্যে আপনি বেশ ভাল টাকা আয় করেন, তখন আপনার মধ্যে কিছুটা হলেও অহংকার জন্ম নিতে পারে। আপনার আচরণে দাম্ভিকতা প্রকাশ পেতে পারে। আর আমরা তো জানি যে, অহংকার মানুষকে ধ্বংস করে।

তিন- আপনার আয় এর সঠিক অংক আপনার পরিবার বা বন্ধু কিংবা আত্মীয় সজনরা জানলে আপনার প্রতি তাদের এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। কারণ আপনার সামর্থ্য কতটূকু তা তারা জেনে যাবে। তারা তাদের মত করে চিন্তা করবেন। আপনি যদি তাদের আবদার না মেটাতে পারেন, তখন  তারা আপনার প্রতি অখুশি হবেন। আর এতে আপনার সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি হতে পারে।

এই নেতিবাচক প্রভাবগুলো থেকে বাচার জন্য সর্বদা আপনার আয় অথবা আপনার নিকট থাকা টাকার অংক গোপন করাই শ্রেয়। যদি কেউ আপনার আয় সম্পর্কে প্রশ্ন করে, তখন আপনি বলতে পারেন- আল্লাহর রহমতে ভাল বেতন পাই। কিংবা আপনাদের দোয়ায় আর আল্লাহর রহমতে পরিবার নিয়ে ভালই চলে যায়।  টাকার অংক সঠিকভাবে বলার দরকার নেই।

৩. অযথা কাউকে টাকা প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকবেন

আমার এই কথাটির সাথে হয়ত আপনি একমত নাও হতে পারেন। অনেকে আবার একে গোঁড়ামি হিসেবে অভিহিত করবেন। কিন্তু এ বিষয়টি অতীতে অনেক বার সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের মাঝে অনেকেই মানিব্যাগে কিংবা পকেটে অনেক গুলো টাকা এক সাথে রাখে। আর যখন ই কোন কোথাও টাকা দিতে হয়, তখন এক সাথে সব টাকা গুলো বের করে সেখান থেকে দেয়।

এটির সাথে আগের পয়েন্ট টির খানিকটা মিল আছে।আপনি যখন সকলের সামনে অনেকগুলো টাকা বের করবেন তখন আপনার মনে এ ধরনের চিন্তার উদয় ঘটতে পারে, যেমন- “দেখো আমার কাছে অনেক টাকা আছে” অথবা “তোমা্দের থেকে আমি অনেক বেশি টাকা উপার্জন করি”। এটি আপনি সামনা সামনি না বললেও আপনার অবচেতন মনে এ ধরনের চিন্তা আসতে পারে। অর্থাৎ পূর্বের ন্যায় আপনার মনে অহংকার বাসা বাধতে পারে, যার পরিণাম ধ্বংস।

আবার অন্যদিকে আপনার টাকা যখন অন্যরা দেখবে তখন তাঁদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করবে। অনেকে ভাববেন,”ইশ আমারও যদি ওর মত টাকা থাকত!”। সাধারণ চোখে আপনি এর মধ্যে কোন নেতিবাচক প্রভাব দেখবেন না। কিন্তু একটু গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করলে আপনি বুঝতে পারবেন অন্যের এ ধরনের চিন্তায় আপনি কিভাবে অর্থ-সম্পদ হারিয়ে ফেলতে পারেন।

মানুষ তাঁর ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে যে কোন কাজ করতে পারে। আর ইচ্ছা শক্তি মানুষের প্রবল বাসনার মধ্যে জন্ম নেয়। টাকার পরিমাণ পৃথিবীতে কমে না, বরং বাড়ে। তবে যা হয়, তা হল এই টাকা বারংবার মালিকানা বদল করে। এমনও হতে পারে, যে বা যারা আপনার টাকা দেখল, তাদের প্রবল ইচ্ছা শক্তি বা আকাংখার কারণে আপনার অর্থ কোন না কোন ভাবে মালিকানা বদল হয়ে অন্য কারো নিকটে অথবা তাদের কাছেই চলে গিয়েছে। সেটা কি খুব বেশি ভাল হবে?

৪. টাকার অপব্যয় আপনাকে ধ্বংস করবে

পৃথিবীর সকল ধর্মেই অপব্যয় এর কুফল সম্পর্কে সকলকে অবহিত করা হয়েছে। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক ঘোষণা দিয়েছেন যে “অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই”। অতীতে অনেক ধনী বংশ তাঁদের অপব্যয় এর কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এমন হয়েছে যে, পরিবারের কোন এক সদস্যের অপব্যয় এর অভ্যাসের কারনে সে পরিবার পথের ফকির হয়ে গেছে।

আমাদের জানতে হবে অপব্যয় আসলে কি। জনৈক এক ব্যক্তি অপব্যয়ের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে- “আপনার যখন যেটা খেতে মন চায়, সেটা খাওয়া- যখন যেটা পোশাক পরতে মন চায়, সেটা পরা ও যখন যেটা কিনতে মন চায়, সেটা কেনা ই হল অপব্যয়”। অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় কিছু কেনার নাম ই হল অপব্যয়।   

দৈনন্দিন জীবনে অপব্যয় থেকে দূরে থাকতে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে পারেন।

  • কোন জিনিস খেতে মন চাইলে ভেবে দেখুন আপনি সত্যিই ক্ষুধার্ত কি না।
  • কোন পোশাক পছন্দ হলে ভেবে দেখুন আপনার কোন পোষাক কি পড়ার অযোগ্য হয়ে গেছে যা আপনি গত ০১ মাস যাবত পড়েন নি? আপনার কি বেড়াতে যাওয়ার জন্য কোন একটি কাপড় নেই? অর্থাৎ নেহাত ই প্রয়োজন ছাড়া কোন প্রকার পোশাক কেনা যাবে না।
  • এছাড়া অন্য কোন জিনিস কেনার জন্য মনস্থির করলে আপনার পরিবার বা বন্ধুর সাথে আলোচনা করুন। এর মাধ্যমে ওই জিনিস আপনার বর্তমান সময়ের জন্য কতটা প্রয়োজনীয় সেটা বের করতে পারবেন।
  • এরপরেও যদি আপনার কোনো কিছু কেনার ইচ্ছা হয়, তবে ভেবে দেখুন আপনার কোন প্রয়োজনীয় জিনিস আছে কি না- যা এখনো কেনা হয় নি।সেরকম থাকলে চটপট সেটা কিনে নিতে পারেন। 

৫. টাকাকে ভালবেসে কাছে রাখতে হবে

আপনার ভালবাসার মানুষটির সাথে যদি আপনার সম্পর্ক ভালো না থাকে, তবে কি সব কিছু খালি খালি লাগে? চারদিকে শূন্যতা অনুভব হয়? আপনার প্রিয় মানুষটি যদি আপনাকে দূরে ঠেলে দেয়, তবে কি আপনি স্বেচ্ছায় তাঁর কাছে যাবেন? কখনোই না! ঠিক তেমনি আপনি যদি টাকাকে আপনার কাছে না রাখেন তবে সে আর আপনার কাছে ধরা দেবে না।

টাকা ২৪ ঘন্টা জেগে থাকে। তার খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, ঘুম নেই। জেগে থাকতে থাকতে সে বিরক্ত হয়। যে ব্যক্তি তাকে কাছে রাখতে চায়, টাকা তাঁর কাছেই যাবে। টাকা একা একা থাকতে মোটেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।

এখন প্রশ্ন হল আপনি কিভাবে টাকাকে ভালবাসবেন আর কিভাবেই বা তাকে কাছে রাখবেন। এর মানে কি আপনি বনের রাজা ওসমান গণির মত লেপ-তোশকে টাকা রেখে তাঁর উপরে ঘুমাবেন? নাকি সব সময় টাকার ব্যাগ নিয়ে ঘুরবেন?

কোনটিই না। টাকার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের একমাত্র উপায় হচ্ছে টাকার হিসাব রাখা। আপনি কোথা থেকে কত টাকা আয় করলেন, কোথায় কোথায় কত টাকা ব্যয় করলেন সব কিছুর হিসাব লিখিত থাকতে হবে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্জন্ত, চা-বিল থেকে ফোন রিচার্জ- সব কিছুর হিসাব লিখিত আকারে রাখতে হবে। এভাবে প্রতি সপ্তাহ, মাস ও বছরের হিসাব লিখে রাখতে হবে। মনে রাখবেন, কোন কিছু লেখা না থাকলে সেটার অস্তিত্ব পৃথিবীর কোথাও নেই।

পরিশেষে…

আপনার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন শুধুমাত্র আপনিই করতে পারেন। প্রাত্যহিক জীবনে উপরের প্রবাদগুলো মেনে চললে আপনি অবশ্যই অর্থকস্ট থেকে মুক্তি পাবেন। যা পরবর্তীতে আপনাকে অনেক ধনী বানাতে সাহায্য করবে। মনে রাখবেন, টাকা আয় করা কোন ব্যাপার না, ব্যাপার হল টাকা ব্যয় করা।

এর মধ্যে আপনি কোন অভ্যাসটি বাস্তবায়ন করতে চান, কমেন্টের মাধ্যমে জানান।

লেখক-

রাকিবুল ইসলাম
প্রতিষ্ঠাতা, রাকিবস আই এল সি